জীবন দিয়ে ঋণী করে গেলেন আমাদের


শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, তুখোড় রাজনীতিবিদ ও খুবই মেধাবী সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিকতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎসময়কার মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বর্তমান ভিসি আ.আ স.ম আরেফিন সিদ্দীক তাঁরই সহপাঠী। পরীক্ষায় মাত্র ৩ মার্ক কম পাওয়ার অভিযোগে কামারুজ্জামানকে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট ঘোষণা করা হয়নি। বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর জেলা সদরের অদূরে বাজিতখিলা গ্রামে জন্ম হয় আপোষহীন বীর কামারুজ্জামানের। গত ১১ এপ্রিল ২০১৫ তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়।  অটল-অবিচল থেকে একজন আপোষহীন নেতা হিসেবে প্রাণ দিয়ে তিনি আমাদের আরও ঋণী করে গেলেন। আমরা দেশবাসী শুধু রয়ে গেছি কালের সাক্ষী হিসাবে। কিন্তু, যাদের জন্য যাওয়া, যে কারণে যাওয়া! আগামী সময় কি তা বিচার করবে? এই কঠিন ভার কি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সইতে পারবে? খবরে প্রকাশ, ফাঁসি দেবার আগে ১১ এপ্রিল’১৫ বিকালে তাঁর পরিবারবর্গ কামারুজ্জামানের সাথে শেষ সাক্ষাৎ ও বিদায় জানাতে যান। সাথে তাঁর স্ত্রী, ৩ ছেলে, ১ মেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। বের হয়ে এসে জেল গেটে অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমে তারা হাত উচিয়ে বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শন করেন। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সবাই। কামারুজ্জামান সে সময় তাদের কাছে পেয়ে কি পানি পড়া পান করালেন যে, রক্তের বাঁধন- সেই আপনজনেরা অকাতরে ত্যাগের নজরানা পেশ করলেন। দ্বিধা সংকোচ কিংবা অন্য কোনো পরওয়া তাদের মাঝে কাজ করেনি। তারা যেন সবরের এক এক পাহাড় হয়ে বেরিয়ে এলেন জেলের গেট দিয়ে। যেন বাপকা বেটা, রাহবার কা ফ্যামেলি। হাসান ইকবাল ওয়ামী বললেন, আব্বু মোটেও বিচলিত নন। তিনি স্বাভাবিক আছেন। দেশবাসীর কাছে তিনি দোয়া চেয়েছেন। শুধুমাত্র ইসলামের স্বার্থে আপনজনকে হারানোর বেদনা! নিঃসংকোচে সহ্য করে মেনে নেয়ার যোগ্যতার পরীক্ষা!! আমার মনে হয় শহীদ কামারুজ্জামানের পরিবার এখানে স্বার্থকভাবে সফল হয়েছে। যেমন ঈমানী পরীক্ষায় সফল হয়েছেন শহীদ কামারুজ্জামান। প্রতিপক্ষ চেয়েছিল, কামারুজ্জামান যেন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করেন। যাতে মুমিন এই সিপাহসালারের ঈমানী চেতনা নিয়ে কিছুদিন নাটক করার সুযোগ পাওয়া যায়। শহীদ কামারুজ্জামান ‘শয়তানের হাসি’তে থু থু দিলেন। তিনি তাঁর গোঠা জীবনের দেয়া বক্তৃতা-বিবৃতির আমলের ওপর অটল রইলেন। আপোষ করেন নি।
শহীদ কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ওয়ামী জানান, তাঁর পিতা শহীদ কামারুজ্জামান বিদায় লগ্নে বলেছেন, সাঈদী সাহেব, নিজামী ভাই, মোজাহিদ ভাইর কাছে বলিও আমি আপোষ করিনি। দেশবাসীর কাছে আমার সালাম জানিও। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে এ সময় প্রত্যক্ষ করল গোটা বিশ্ব। অনেকের মনে তখন একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল! সবাই কেন শুধু বিজয়ের চিহ্ন দেখায়। কাদের মোল্লাকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয় তখন একই চিত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন জানানোর কথা বললে কামারুজ্জামান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলীকে জানালেন, “রাষ্ট্রপতি প্রাণ দেওয়ার ও নেওয়ার কেউ নন যে, তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে হবে।” তিনি নির্ভয়ে, নি:সঙ্কোচে আপোষহীন কামারুজ্জামান হয়ে রইলেন। আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। সময়-ক্ষণ যত এগিয়ে আসতে থাকল তিনি ততই হাসি মুখে দুনিয়াকে বিদায় জানাতে থাকলেন। তিনি অজু-গোসল করে ফাঁসির মঞ্চের জন্য একজন প্রধান অতিথির প্রস্ততি নিলেন। সাদা ভাত, মোরগের গোশত ও মাছ দিয়ে দুনিয়ার জীবনের শেষ খাবার তিনি গ্রহণ করলেন। পরে হেসে হেসে জল্লাদের সাথে গল্প করে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন। তাকে টেনে হেঁচড়ে নেয়ার দরকার পড়েনি। শহীদ কামারুজ্জামান হয়ে উঠলেন এক জীবন্ত লাশ। আমরা জানি না, তিনি আর কি করেছেন? কি কি কথা বলেছেন। খুব বেশি জানার সুযোগ আমাদের হয়নি। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগে যা এসেছে, শুধু তাই আমরা জানতে পেরেছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা যায়, শহীদ কামারুজ্জামানের শেষ ইচ্ছা ছিল ফাঁসি দিতে হলে তাকে যেন শুক্রবার জুমআর দিনে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং গোসল ছাড়াই যেন দাফন করা হয়। যাতে তিনি রক্তমাখা শরীর নিয়ে একজন শহীদ হিসাবে তাঁর রবের দরবারে কিয়ামতে আদালতে এমনভাবে মিলিত হন যে, তিনি একজন শহীদ। “জালেমরা তাকে শহীদ করেছে। তার একটিমাত্র অপরাধ যে, তিনি মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাতেন।” কিন্তু, কাপুরুষ গোষ্ঠী, ফাসেকের অনুসারীরা শহীদ কামারুজ্জামানের শেষ ইচ্ছাটুকু আমলে নেয়নি এবং পূরণ করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি পরিবারের কেউ কেউ জানাজায় পর্যন্ত অংশ নিতে পারেনি। যেমনটি হয়রানি করা হয়েছিল, শহীদ কাদের মোল্লার সময়ে। অবশ্য, দেশে-বিদেশে শত শত জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে এসব শহীদদের জন্য। বেদনাহত হাজার হাজার মানুষ ছুটে গেছেন  জানাজায়, শেষ বিদায় জানাতে। ফরিয়াদ প্রকাশ করতে। সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে শহীদ কামারুজ্জামানের গায়েবানা জানাজার বিশাল উপস্থিতিতে জানাজা পূর্ব সমাবেশে অধ্যক্ষ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বললেন, দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে একজন প্রকৃত মুমিনের আকাক্সক্ষা থাকে -তাঁর যেন শহীদী মৃত্যু নসিব হয়। শহীদ কামারুজ্জামানের ভাগ্যে সেটা অর্জন সম্ভব হয়েছে। তাই তাঁর সাথীরা এবং তাঁর পরিবারবর্গ বিজয়ের  চিহ্ন ‘ভি’ দেখাচ্ছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামানের বয়স হয়েছিল মাত্র ১৭ বছর। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয় তা অবান্তর। কারণ, এই সব অভিযোগে তো তাকে ফাঁসি পর্যন্ত দেওয়া হয়ে গেছে। তিনি চলে গেছেন অপারে-সুন্দর ভবনে। না ফেরার দেশের বাসিন্দা এখন শহীদ কামারুজ্জামান। আর তৎসময়কার ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী সহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী সেই সময়ের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় আজ বিচার থেকে রেহাই পেয়ে গেলেন? জানা যায়, ২০১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে এতসব অভিযোগ তো দূরের কথা কোনো একটি জিডি পর্যন্ত কেউ করেনি।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ছিলেন একজন উঁচুমানের লেখক। পেশাগত জীবনে একজন মেধাবী সাংবাদিক। ইসলামী আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ দূরদৃস্টি সম্পন্ন তুখোড় রাজনীতিবিদ। বহু গ্রন্থ প্রণেতা। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র, বাংলাদেশের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও নীতি নির্ধারক। এমন মাপের একজন নেতাকে নিন্দুকেরা গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি তাঁর শেষ বিদায় অনুষ্ঠান-জানাজার নামাজটি পর্যন্ত আশানুরূপ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে দেয়নি। ১১ এপ্রিল থেকে গোটা বাজিতখিলা গ্রামে পুলিশ রেড এলার্ট করে রাখে। যাতে জানাজায় লাখো মুসল্লি অংশ নিতে না পারে। শহীদ কামারুজ্জামান আজ আর পৃথিবীতে নেই। প্রতিপক্ষেরা তাঁকে থাকতে দেয়নি। তাঁর শূন্যস্থান সহজে পূরণ হওয়ার নয়। জাতি অকালে হারাল তাঁর একজন গর্বিত সন্তানকে। আমি বলবো, তাঁর মতো কামারুজ্জামানদের জন্ম এই পৃথিবীতে খুব কমই হয়। তিনি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ তাঁর থেকে অনেক কিছু পাবার ছিল। আমার মনে পড়ে, কামারুজ্জামানের ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তগুলো। নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন সময় ছিল, টান টান এই সময়ের চিত্র মুছে যায়নি। মনে হলে এখনো আঁতকে উঠি। নিষ্ঠুর দানবেরা কিভাবে তাঁকে গ্রাস করল। আর দেশপ্রেমিক-সচেতন দেশবাসী দাবিদার (?) গোষ্ঠী আমরা অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে রইলাম ...।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট