করি নিয়ে গেছেন ২৯৮ জন হংকংয়ে চাকরির স্বপ্ন পূরণে বগুড়ায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ৫৪ নারী


নিজের জীবনের পুনরাবৃত্তি মেয়ের জীবনে দেখতে চান না মেরিনা। তাই চোখে-মুখে একরাশ স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে পাড়ি জমাতে চান মুক্তবন্দর ও বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যের শহর হংকং এ। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে মেরিনার বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সেই। তখনও স্কুলের গন্ডি শেষ হয়নি। কিশোরী শরীরেই লাল বেনারসী জড়িয়ে বাবা-মা পাঠিয়েছিলেন শ্বশুর বাড়িতে। ওই কিশোরী বয়সেই পর-পর দুটি সন্তানের মা হন মেরিনা। সন্তান দুটো একটু বড় না হতেই তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। হঠাৎই স্বামী তার অনুমতি না নিয়ে আর একটি বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসেন। দ্বিতীয় স্ত্রী ঘরে আসার পর শুরু হয় মেরিনার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। বাধ্য হয়ে সে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে আসেন। শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। আর্থিক কষ্টে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া যখন বন্ধের উপক্রম, সেই সময় হংকং-এ চাকরিরত এক বান্ধবীর চিঠিতে জানতে পারেন, বাংলাদেশ থেকে চাকরি নিয়ে অনেক নারী শ্রমিক হংকং যাচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণে কোথায় কীভাবে সুযোগ পাওয়া যাবে, চিঠিতে সে বিষয়টিও ছিল। এরপরই হংকং-এ চাকরি পাওয়ার আশায় ঢাকায় জব ফেয়ারে অংশগ্রহণ করেন মেরিনা। সেখানে প্রাথমিকভাবে মনোনীত হওয়ার পর মেরিনাকে বগুড়া কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) তে প্রেরণ করা হয় দুই মাস মেয়াদী 'ইন হাউস ট্রেনিং'র জন্য। আর মাত্র পনের দিন পরই শেষ হয়ে যাবে মেরিনার ট্রেনিং। এরই মধ্যে পাসপোর্ট ও ভিসা হয়ে গিয়েছে। এখন তার একটিই স্বপ্ন ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করা। বিশেষত মেয়েকে। মেরিনা বলেন, আমার মেয়ের লেখাপড়ার খুব শখ। মাথাও ভাল। ৮ম শ্রেণীতে পড়ছে। ক্লাসে সে প্রথম। তাই মেয়েকে নিয়েই বেশি স্বপ্ন দেখছি। প্রায় একই রকম গল্প তানিয়া আকতার সুবর্ণার। মেরিনার থেকেও কম বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল মাদারীপুরের সুবর্ণার। পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ শেষ না হতেই বর্গাচাষী বাবা সুবর্ণাকে পাশের গ্রামের এক জাল বিক্রেতার সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের কিছুদিন না যেতেই তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেন। তারপরও সবকিছু সহ্য করে স্বামীর সংসার করছিলেন সুবর্ণা। এরই মধ্যে তার কোলজুড়ে আসে দুটি পুত্র সন্তান। কিন্তু স্বামীর স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। একের পর এক বিয়ে করতে থাকে। এক পর্যায়ে সন্তানসহ সুবর্ণা ওই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। বাপের বাড়িতে খুব কষ্টে যখন দিন পার করছিলেন, তখন একদিন এক বোনের সহযোগিতায় হংকং এ চাকরি নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বগুড়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) তে 'ইন হাউস' প্রশিক্ষণের জন্য অংশগ্রহণ করেন। হংকং-এ মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণের জন্য বগুড়া টিটিসিতে 'হাউসকিপিং এন্ড ক্যানটনস্ ল্যাংগুয়েজ' বিষয়ে 'ইন হাউস ট্রেনিং' চলছে। বগুড়া টিটিসি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং হংকংয়ের সিটি এমপ্লয়মেন্ট প্যারাডাইস হংস এবং হুয়ার ফাই (এইচকে) এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি'র সহায়তায় বগুড়াসহ দেশের ৬টি জেলার টিটিসিতে ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট থেকে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। দুই মাস মেয়াদী এই প্রশিক্ষণে হংকং'র ভাষা, কম্পিউটার, রান্না, আচরণ এবং শিশু ও বৃদ্ধদের পরিচর্যার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের নির্বাচন করা হয় জব ফেয়ারের মাধ্যমে। জব ফেয়ারে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে নূ্যনতম অষ্টম শ্রেণী পাশ এবং বয়স হতে হবে ২৫ থেকে ৩৮ বছর। প্রশিক্ষণ শেষে ওই দুটি এজেন্সি ৪০ হাজার টাকা বেতন ধার্য করে দুই বছরের চুক্তিতে হংকংয়ে নারী শ্রমিক প্রেরণ করে।
সূত্র জানায়, ফেয়ারে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিতদের সাড়ে ৪ হাজার টাকা দিতে হয় মেডিকেল চেকআপের জন্য। মেডিকেল চেকআপের পর পাসপোর্ট নিজ খরচে করে ভিসার জন্য দুই দফায় ২০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। প্রথম দফায় ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়। প্রশিক্ষণের ৫ দিন পর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্লাসের ভিডিও করে ওই দুটি রিক্রুটিং এজেন্সির অনলাইনে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে চাকরিদাতা বিভিন্ন সংস্থা পছন্দের নারী কর্মীকে চিহ্নিত করে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে আবেদন করে। তখন থেকেই ওই কর্মীর হংকং যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বগুড়া টিটিসি'র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, টিটিসি থেকে প্রশিক্ষণের পর চাকরি নিশ্চিত করেই এই নারীদের হংকং প্রেরণ করা হচ্ছে। এই নারী কর্মী পাঠাতে ভিসা ও স্মার্ট কাটসহ খরচ পড়ছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই টাকা প্রশিক্ষণার্থীদেরই দিতে হচ্ছে। যারা নগদ টাকা দিতে পারেন না তারা ক্যাম্পাসের ভিতর থাকা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ১লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নিতে পারেন। সরল সুদে এই ঋণ দেওয়া হয়। হংকং যাওয়ার পর ৬ মাসে তাদের বেতন থেকে ওই ঋণ শোধ করা হয়। 
মিজানুর রহমান আরও জানান, মোট ৮ জন প্রশিক্ষক এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এরমধ্যে বাংলাদেশের চারজন এবং বিদেশী চারজন। টিম লিডার হিসেবে প্রশিক্ষণটি পরিচালনা করছেন হংকং'এর হেড অফ দি রিপ্রেজেন্টেটিভ ভেনি। হেড অফ দি রিপ্রেজেন্টেটিভ ভেনি জানান, বগুড়া ছাড়াও ঢাকার কেরানীগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় এই ট্রেনিং চলছে। প্রতিমাসেই হংকং'র ওই দুটি এজেন্সির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জোজো এবং মিস ক্রিস ট্রেনিং সেন্টারগুলো পরিদর্শন করেন এবং প্রশিক্ষণার্থীদের খোঁজ খবর নেন। টিটিসি'র হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট রিয়াজ আহমেদ জানান, সরকারের ৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের সঙ্গে হংকংয়ের সিটি এমপ্লয়মেন্ট প্যারাডাইস হংস এবং হুয়ার ফাই (এইচকে) এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি'র চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট বগুড়ায় এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। ২শ' আসন বিশিষ্ট এই প্রশিক্ষণে এ পর্যন্ত ৫৪৭ জন ট্রেনিং নিয়েছে। এরমধ্যে চাকরি নিয়ে হংকং গিয়েছেন ২৯৮ জন। প্রক্রিয়াধীন রয়েছেন আরও ২০ জন। বর্তমানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ৫৪ জন। তিনি আরও জানান বিভিন্ন জেলায় জব ফেয়ারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন করা হলেও স্থানীয়রা সরাসরি ওই কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হতে পারেন। আগামি ৯ জুন সাতক্ষীরায়, ১০ জুন যশোর এবং ১৪ জুন ঢাকায় জব ফেয়ারের মাধ্যমে যেসব নারী নির্বাচিত হবেন, তাদেরকে বগুড়ার এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আনা হবে বলেও তিনি বলেন।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট