অভিযোগ পেয়েও আমলে নেয়নি নির্বাচন কমিশন


ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অনিয়ম সম্পর্কে জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। ভোট জালিয়াতির দৃশ্য দেখার পর এবং প্রার্থীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পরও কমিশন তা আমলে নেয়নি। উল্টো দাবি করেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।

নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের অনেকের মতে, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কমিশনের অধীনে থাকলেও এই বাহিনীর ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এ ছাড়া কমিশনের ওপর সরকারের চাপও ছিল, যে কারণে ঢালাও আচরণবিধি লঙ্ঘন, প্রার্থী ও ভোটারদের পুলিশি হয়রানি এবং কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেওয়ার উৎসব চললেও কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

কমিশন সচিবালয়ের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা জানান, ভোটের দিন বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিশন থেকে পুলিশ প্রশাসনকে জানানো হলেও তারা তা আমলে নেয়নি। কর্মকর্তাদের মতে, শুরুতে প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগের ক্ষেত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। কমিশনের এই নিষ্ক্রিয় ভূমিকার ধারাবাহিকতা থেকেই ভোটের দিন কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে।

নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ভোটের দিন সকাল ১০টা থেকে রাত পর্যন্ত উত্তর সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষ থেকে ২০-৩০টির মতো অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে এসেছিল। কমিশন একটি অভিযোগও তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করে দেখেনি।

এর আগে ২৬ ও ২৭ এপ্রিল বিএনপি-সমর্থিত ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের শতাধিক অভিযোগ টেবিলে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ২৭ এপ্রিল রাতে কিছু অভিযোগ বাছাই করে তা কমিশনে পাঠানোর জন্য নথিভুক্ত করা হয়। বাকিগুলো ঝুড়িতে নিক্ষেপ করা হয়। এসব অভিযোগে বেশির ভাগ প্রার্থী বলেছেন, সরকার-সমর্থিত লোকজন তাঁদের এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী ও সমর্থকদের ২৫ এপ্রিল রাত থেকেই পুলিশ তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

কমিশনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বাছাই করা অভিযোগগুলোও ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর কমিশনে উত্থাপন করা হয়। যথাসময়ে উত্থাপন না করার প্রশ্নে কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন এসব অভিযোগকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। তাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আগে উত্থাপন করে অভিযোগগুলো পরে উত্থাপন করা হয়েছে।

২৮ এপ্রিল ভোট গ্রহণের দিন ঢাকা উত্তর সিটির ইস্পাহানী উচ্চবিদ্যালয়, কাফরুল উচ্চবিদ্যালয়, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়, ভাষানটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিরপুর বাংলা কলেজসহ মোহাম্মদপুরের একাধিক কেন্দ্র এবং দক্ষিণ সিটির বিজয়নগরের মূক ও বধির কেন্দ্র, ওয়ারীর সিলভারডেল বালিকা বিদ্যালয়, দক্ষিণ মৈশুন্ডি বালিকা বিদ্যালয়, নারিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফকির চাঁদ কমিউনিটি সেন্টার, শাহজাহানপুরের মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজসহ আরও অসংখ্য কেন্দ্রে প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটে। দলীয় সমর্থকদের পাশাপাশি ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যরাও এ কাজে অংশ নেন। এসব কেন্দ্র থেকে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র-কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। এমনকি মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালকেও একাধিক কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়। পুলিশ ও সরকার-সমর্থিতরা সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেন।

এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিক অভিযোগ এলেও দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বাকিগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া দূরের কথা, বিষয়টি আমলেই নেয়নি কমিশন।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন অনিয়ম সম্পর্কে জানার পর ব্যবস্থা নেয়নি, এমন অভিযোগ সত্য নয়। আর প্রার্থীরা যেসব অভিযোগ করেছেন, সেগুলোর পরিণতি কী হয়েছে, সেটা কমিশন সচিবালয় বলতে পারবে। কারণ, এ-জাতীয় কোনো অভিযোগ তাঁদের নজরে আনা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে কমিশন সচিবালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগ তো অনেক এসেছে। সেগুলো আমরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। তা ছাড়া বেশির ভাগ অভিযোগই অগ্রহণযোগ্য ছিল। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।’

কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, কমিশন ভোটের দিন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ৭৪টি কেন্দ্রে ৫৩ জন নিজস্ব পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে। এঁদের সঙ্গে ল্যাপটপ ও ওয়েবক্যাম সরবরাহ করা হয়। এসব পর্যবেক্ষক কী দেখেছেন এবং ক্যামেরায় কী ধারণ করেছেন, সে বিষয়ে এখনো কমিশন থেকে কোনো আগ্রহ দেখানো হয়নি। এ বিষয়ে কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকেও কিছু জানাতে ভয় পান।

একাধিক পর্যবেক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাঁদের হাতে ক্যামেরা তুলে দেওয়া হয়। যে কারণে তাঁরা সঠিকভাবে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে পারেননি। কয়েকজন বলেছেন, সরকার-সমর্থিত প্রার্থীর লোকজন মারধর করবে, সেই ভয়ে তাঁরা ক্যামেরা বের করেননি।

নির্বাচন কমিশনে নির্বাহী হাকিমদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য তাঁরা মাঠপর্যায়ে বেশ কয়েকজন প্রার্থীসহ অনেককে জেলা-জরিমানা করেছেন। কিন্তু জাদরেল মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের বিরুদ্ধে তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি।

তফসিল ঘোষণার পর থেকে ঢালাও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও কমিশন তা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। উত্তর সিটির মেয়র পদপ্রার্থী আনিসুল হককে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দায় সেরেছে। দক্ষিণ সিটিতে মসজিদে ভোট চাওয়ার পরও সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ খুঁজে পাননি রিটার্নিং কর্মকর্তা। চট্টগ্রামে গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন মেয়র পদপ্রার্থী আ জ ম নাছিরকে পাশে রেখে ভোট চাওয়ার পর এবং এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগের সত্যতা পেলেও কমিশন সেখানে কোনো অপরাধ খুঁজে পায়নি।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিশন একটি প্রহসনের নির্বাচন উপহার দিয়েছে। এখন তাদের অবস্থা হয়েছে এমন যে কোনো কিছু দেখব না, শুনব না, কোনো ব্যবস্থাও নেব না। বুঝতে পারছি না, তাদের মধ্যে কি নিরপেক্ষতার অভাব, নাকি নিজেরাই জানে না তারা সাংবিধানিক পদে আছে। তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন করা।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট