হারিয়ে গেছি একদিন


কমলা কালো ডোরাকাটা মাঝারি একটা বল। বসার ঘরের দেয়ালে ছুড়ে দেয়া আর লুফে নেয়া এই হলো খেলা। মোটামুটি ঘোর লাগা খেলা ঘন্টা পার করে দেয়া যায়। যার ওই ঘোড় কোন দিন লাগেনি সে বুঝবে না। খেলা বন্ধের জন্য ২ বার মৃদু একবার সাবধান বাণী আর একবার গর্জন হয়ে গেছে। কে শোনে কার কথা। হঠাত বলটা ফসকে গেল। পরবি তো পর মালির ঘাড়ে। পর্সেলিনের লাফিং বুদ্ধ হাসতে হাসতে আমাকে ডুবিয়ে পরপারে চলে গেলেন। সেদিন, আমি একটা চড় খেয়েছিলাম দিদির হাতে। এমন ২/১টা চড় খাওয়া কিন্তু কোনো ব্যপার নয়। এমন না হলে বড় হবার ইচ্ছেটাই তো মরে যায়। আসল বিষয়টা ছিল ওই চড় খেয়ে অভিমানটা। ফুলে ফুলে কাঁদতে কাঁদতে মনে হয়েছিল বাড়ি ছেড়ে চলে যাব একা আর কোনদিন ফিরে আসব না। কল্পনার জগতে কত যে হিসেব কষা বাড়ি থেকে বের হয়ে কমলাপুর স্টেশন তার পর দূর কোন গ্রাম একা থাকব মাটির চুলোয় রান্না করে খাব। বৈষয়িক কোন ভাবনা বাদে নির্ভেজাল স্বপ্ন মন্থিত কল্পনা। তেমন করে আর বাড়ি পালান হয়নি কোনদিন।
ছোটবেলা খুব চিঠি লিখতাম বন্ধুদের কে। আমি একা না আমাদের সব বন্ধুরাই লিখত একে অপরকে। কেন লিখতাম জানি না হোমওয়ার্ক এর একটা বড় সময় নষ্ট হতো এই অকাজে। কোন কাজের কথা না যাবতীয় আজব অদ্ভুদ অলীক কথা ভর্তি চিঠি। এই চিঠিগুলো লিখতে আর পেতে কি পরিমান আনন্দ হতো সেটা মনে হয় কখনই ব্যাখ্যা করে বুঝানো যাবে না। বন্ধুরা সে সময় পৃথিবীর সব থেকে আপন ছিল হাঁ মনে হয় বাবা মা ভাই বোন থেকেও আপন। একসময় আমাদের চিঠি লেখা বন্ধ হল। একসময় জীবনের টানে সব থেকে আপন বন্ধুরা ছিটকে গেল এক এক দিকে। অভিমান, দুঃখ আর কত মিশ্র অনুভুতি এবং কি তীব্র সেই হারানোর কষ্ট। মনে হতো ধুর আমিও হারিয়ে যাবো একদিন।
তার পরে, ছোটবেলায় আমার খুব অদ্ভুত কিছু খেলা ছিল ভাঙ্গা ইটের টুকরো পাথরে ঘষে বিভিন্ন সুন্দর আকৃতি দেয়া। বিশেষ কিছু যে বানাতাম তা নয় কিন্তু ইটের মসৃন কিছু আকৃতি। আমি নিজেও ব্যাখ্যা দিতে পারব না কেন এত পরিতৃপ্তি হত। আমি বুঝি কিছুটা সময় নিজেকে একজন ভাস্কর ভেবে নিতাম। আমার কোনো পুতুল ছিল না। না একটাও না। আমি পুতুল খেলা বিষয়টা কোনো দিন বুঝি নি এখনো বুঝি না। আমার খেলা ছিল গাছের ডালে বসে থাকা।ঘুড়ি উড়ানোর চেষ্টা করা। স্কুলের গাছ থেকে পা ফস্কে পরে হাটু পা কেটে একাকার করেছি কত বার হিসেব নেই। এই পরিতৃপ্তি, না বুঝতে চাওয়ার উদাসীনতা, গাছে উঠা বা ঘুড়ি ওড়ানর সতন্ত্র চেষ্টা সবই ছিল খুব ভীষণ আর স্পষ্ট। সে সময় এত পরিতৃপ্তির মাঝেও অন্য রকম একটা না পাওয়া আর একটা অস্থিরতা কাজ করতো, সব ভেঙ্গে বেরিয়ে যাবার প্রবল আগ্রহ অধীর করে রাখতো।
ছোটবেলার সব অনুভুতিগুলোই ছিল তীব্র খুব সরল আর খাঁটি। একসময় বাড়ি ছেড়ে পালানোর সপ্ন দেখা আমি সত্যি সত্যি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলাম। পড়তে চলে গেলাম অনেক দূরে। সেই থেকে একটু একটু করে সব বদলানর পালা। প্রচণ্ড আবেগি আর বোকা বোকা রোম্যান্টিক একটা জীবন থেকে একেবারে বাস্তব আর রুক্ষ মাটিতে আছড়ে পরা যেন। রাজকুমারীর জীবনের একটা অধ্যায় নিখুঁত হলে অন্যটি কষ্টের হতেই পারে। এই জীবনে সবই তো সমান ভাগ করে দেয়া। এক লহমায় বড় হয়ে যাওয়া
ধীরে ধীরে স্বাধীনতার নতুন স্বাদ। নতুন কিছু অনুভুতি। সেই যে ছেলেবেলায় একা হওয়ার সপ্ন তারই আনন্দ বার্তা যেন চারদিকে। নতুন শহর নতুন দেশ যেন নতুন করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। একসময় কিছু নতুন মানুষের সাথে পরিচয়। বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব কি ঠিক বলা যায়? ছেলেবেলায় যে নিষ্পাপ স্বার্থহীন বন্ধুত্ব হয় বড় বেলায় তা ঠিক হয়ে ওঠে না। বড়বেলায় যা হয় সেটা চক্র বা সারকেল। কিছু সহমতের মানুষের একসাথে চলা মতের অমিল হলেই চক্র থেকে ছিটকে পরা। আবার একা হওয়া আবার নতুন কোন চক্র। এক সময় জীবনের নানা জটিলতা। অনেক অনেক দায়িত্ব। হাজার কাজের আর কর্তবের বোঝায় আশে পাশে হাজার মানুষের ভিড়ে কেমন করে যেন ঘুরে ফিরে সেই চক্র থেকে ছিটকে পরে একা হয়ে যাওয়া।
বাড়ি ছেড়ে পালানোর প্রবল ইচ্ছেটা বিধাতা এমনই ভাবে মেনে নিবেন বুঝিনি। সেই যে বের হয়ে এলাম আর সত্যি করে ফিরে যাওয়া হল না। এখনও বাড়ি ফিরি কিন্তু, বাড়ির মানুষ হয়ে আর ফেরা হয় না ফেরা হয় অতিথি হয়ে। সব থেকে ভাল থাকা, ভাল খাওয়া, ভাল আচার ভাল ব্যবহার সাজিয়ে অপেক্ষা করে বাড়ির মানুষ গুলো। যে বাড়িটা একান্ত নিজস্ব আমার সেই বাড়িটা আমার সামনে তার চোখ মোছেনা কখনই। তেমনি ভাবে আমিও না । সব কিছুতেই আনন্দ সুখের আনাগোনা আর ভালটুকু সবার সামনে তুলে ধরা। নিজের জীবনের ধুসর কালশিটে গুলো সযত্নে রঙ্গিন তুলির আচড় দিয়ে ঢেকে হাস্যজল মুখে ঘুরে বেড়ানো একসময় সেটাই জীবনের সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেবেলার সব অনুভুতির তিব্রতা যেমন অনেক বেশি ছিল। তার প্রকাশও ছিল প্রছন্দ। চেপে রাখার কোন বালাই ছিল না হাসি, কান্না, দুঃখ কষ্ট অভিমান সব যেন নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে দেয়া যেতো। বড়বেলায় এসে অনুভুতি গুলো আরও অনেক বেশি তীব্র অনেক ধারালো শুধু প্রকাশ করা যায়না প্রকাশ করতে নেই। প্রকাশে ছোট হয়ে যেতে হয়। প্রকাশে রহস্য চলে যায়। প্রকাশে মানুষ খেল হয়ে পরে। ধীরে ধীরে একা হয়ে যাওয়া। লক্ষ মানুষের ভিড়ে নিজের সব থেকে সাজানো গোছানো মিথ্যেটাকে আঁকড়ে ধরে নিঃস্ব আর একা দাড়িয়ে থাকা এই বুঝি চরম সত্য এই বুঝি জীবন। তবুও জীবনের নিয়মেই জীবন চলুক তার মাঝে কখনো কোন সময় একফালি রোদ এসে হাঁসিয়ে দিয়ে যাক আর সেটাই কাম্য হোক।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট